""...pure nonsense, pure wisdom of someone who knows nothing..." - From "Poetry" by Pablo Neruda.
Thursday, June 27, 2013
Tuesday, June 18, 2013
একটি তস্য গলির দিনপাত
গলির মধ্যে গলি, তার মধ্যে গলি, তার মধ্যে সে এক তস্য গলি। ডাইনে বাঁয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে গলি থেকে গলিন্তরে। পৃথিবীর সমস্ত তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র জিনিষের মনের কোনে যেমন এক ফোঁটা আশা লুকিয়ে থাকে বৃহৎ এর সাথে মেলার, তস্য গলির ও সে অসুখ হলো। একদিন তার মন করলো রাজপথ দেখতে যাবার। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তস্য গলি বেরোলো রাজপথ দেখতে।
কিন্তু, যায় কোথায়। সে যে দিকেই যায়, সে দিকেই পথ শেষ হয়ে যায়। এক পথ গিয়ে শেষ হয় গেরস্থের রান্নাঘরে, তো আরেক পথ গিয়ে ঠেকে মধ্যবিত্তের একচিলতে ভরসা, একফালি রোয়াকে। যে টুকু বা পড়ে থাকে সেটুকুর চারদিকে শুধু বাড়ি আর বাড়ি। ডাইনে বাড়ি, বাঁয়ে বাড়ি, আর সামনে বাড়ি। এ সবের মাঝে আটকে পড়ে গলির প্রাণ যখন হাঁসফাঁসিয়ে ওঠে, যখন গড়ের মাঠের ঝরঝরে হাওয়া খাওয়ার জন্য তার প্রাণ আকুলিবিকুলি করে, সে তখন ওপরে তাকায়।
সরু একখানা রেখার মতন নীলচে আকাশ। ঠিক তারই মত অপ্রশস্ত, তারই মত অকিঞ্চিতকর। স্থির হয়ে ঝুঁকে পড়ে গলির ভালোমন্দর দেখভাল করছে যেন। একচিলতে গলির একফোঁটা এক আকাশ - সবেধন নীলমনি - তাও তার দখল নিয়েছে গিলগিলে হাড় বার করা একগাদা এন্টেনা, মধ্যবিত্তের শুকোতে দেওয়া সারি সারি শাড়ি, ছোট্ট ছেলের স্কুলে যাওয়ার হাফ প্যান্ট, ডিগডিগে রোগা লোকটার রঙচটা একটা জামা, একপাটি সাদা মোজা, খুকির মাথার ফিতে, আরও কত টুকিটাকি দরকারী সব গেরস্থালি জিনিস। এরই মাঝে উঁকি মারে মিহি রেখার মত নীল আকাশ। দেখে মনে হয় ঠিক গলিরই মত নগন্য, তারই মত বান্ধবহীন, একলা। দিগন্তবিস্তৃত শহরের সেই এক টুকরো নীল আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে কেটে যায় গলির জীবন। একঘেয়ে, ফরমায়েশি, নির্জীব অস্তিত্ব।
একটুকরো হলেও আকাশের জীবনে আছে রঙের বাড়বাড়ন্ত। কোনো এক পর্দার অন্তরাল থেকে এক অজানা কেউ সেই দৈর্ঘ্যহীন প্রস্থহীন সরু রেখাটাতে নিয়ম করে ভরে দেয় বিভিন্ন রঙ। কখনো তা তীব্র সোনালী তো কখনো বা এক ফুরফুরে মিহি হলদে।মিহি হলদের দিনগুলোতে সকাল আটটা বাজতে না বাজতে দু দিকের ছাদগুলো থেকে পুরনো তোষকের মত এলিয়ে পড়ে তুষের মতন ঝিরঝিরে হালকা রোদ। সেদিন ছোট ছেলেমেয়েগুলো স্কুল যায়না। সেদিন ঘড়িতে ন'টা বাজে না। সেদিন কাজের লোক সদর দরজার ঘুম ভাঙ্গায় না। সেদিন বাবুরা আপিস যায় না। সেদিন সারা বছর ধরে জমে থাকা মাছের আঁশ, তরকারির খোসা, মরা ইঁদুর, ফাটা চপ্পল, হলদেটে পুরনো পাতা, আর অলসতা সমস্ত সরিয়ে রেখে বাচ্চাগুলো হৈচৈ করে আসন্ধ্যা। তার শানবাঁধানো চাতালে লাল নীল বলগুলো অহরহ লাফাতে থাকে আর ছেলেমেয়ের দল স্বপ্নাবিষ্টের মত বলগুলোর পেছনে পেছনে ছোটে।
কি আশ্চর্য্য! ঠিক তখনই শ্যওলা ধরা ইট আর সিমেন্ট বিদীর্ণ করে পাথরের মাঝে চোখ মেলে এক সবুজ নবীন চারা। গলির আর তখন একা লাগে না, মনে হয় তার সব আছে, অনেক আছে, অঢেল আছে। তার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে নতুন প্রানের মৃদু কম্পন। তার ও বন্ধু আছে, তার ও যত্ন করার মানুষ আছে, তাকেও সাজাবার মত আপনজন আছে, তার ও সুখদুঃখের কথা বলার মত পড়শী আছে। এমনতর দিনে গলি আড় চোখে তাকায় আকাশের দিকে। মেপে নিতে চায় আকাশের মনকে। সেও কি এত খুশি হলো? সেও কি জানলো যে গলির জীবনেও আছে রাজপথের বৈভব, আছে আড়ম্বরের মহিমা।
মাঝে মাঝে সেই আড়ালে থাকা অজানা অনামা লোকটা বুঝিবা রাগ করে গলির আকাশের খাতা থেকে সব রঙগুলোকে পেন্সিলের আঁচড় দিয়ে কেটে দেয়, গলির বড় লক্ষীছাড়া দশা হয় তখন। জমা ধুলো আর ছেঁড়া কাগজগুলো হাওয়ায় এলোমেলো উড়তে থাকে। চরাচর অস্পষ্ট হয়ে যায়। নীলাভ আকাশ তখন ম্লান, ম্রিয়মান। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গলির শান দেওয়া রোয়াকের বুকে পড়ে তোলে সেতারের মূর্ছনা! সে সুরের মুর্ছনায় আর তালের গৌরবে গলির ছোট্ট একখন্ড বুকটা লাফাতে থাকে। লাফাতে লাফাতে জলের ফোঁটাগুলো কত গল্প করে গলির সাথে। তাদের পূর্ব জীবনের কথা। তারা এতদিন কোন মাঠে-ঘটে, নদে-নালায় অযত্নে পড়ে ছিল, কেমন করে তারা একে একে আকাশে জমা হোলো। কেমন করেই বা তারা নেমে এলো গলির কাছে, রাজপথের কাছে, সবার কাছে। গতকালের মলিনতা ঢেকে দিল উচ্ছল জলধারায়। ক্ষুদ্রর সাথে বৃহতের ব্যবধান মুছে দিল নির্মল আত্মীয়তায়।
তস্য গলির এ সব ব্যঞ্জনা মাথায় ঢোকে না। সে শুধু হাঁ করে অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে আর শোনে। আর ভাবে এখানেই আছে সংসারের সব কিছু। এই রান্নার গন্ধে ভরে যাওয়া গলির মধ্যেই আছে জীবনের সমস্ত রঙ-গন্ধ-বর্ণ-স্পর্শ; এই মেরুদন্ড ঝুঁকে যাওয়া মানুষগুলোর মধ্যেই আছে সংসারের সারসত্য, এই শানবাঁধানো গলিতেই অস্পষ্ট অস্পৃষ্ট হয়ে আছে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড, তার নিত্যসুত্র।
Subscribe to:
Posts (Atom)