কানাডা। ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩।
সেদিন এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যেমনটি আজকাল আর সচরাচর ঘটে না। হিংসা আর পারস্পরিক সন্দেহে দীর্ণ এই আধুনিক পৃথিবীতে যা প্রায় রূপকথায় পর্যবসিত।
মুদির দোকানের জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরব।
হেমন্তের মড়া বিকেল। আকাশময় বিষন্নতা।
গোধুলির ক্ষীন আলোকে প্রায় মুছে ফেলে আকাশে বৃষ্টি-সম্ভবা মেঘেদের দ্রুত আনাগোনা।
ঝিরিঝিরি বইতে শুরু করলো তাদের ধারা। বর্ষাক্রান্ত বিকেলে এক গাদা জিনিসপত্র নিয়ে আমি বিহ্বল। ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষারত।
একা।
অপেক্ষা যেখানে শেষ; বিরক্তি আর উত্কন্ঠার যেখানে সূচনা, সময় সেখানে স্থির।
সহসা পেছন থেকে স্নিগ্ধ কোমল অচেনা গলায় চেনা ব্যাকুলতা, "তোমার ট্যাক্সি এখনো আসে নি?"
- "না, বেশ কিছুক্ষণ হলো, এই হয়ত এসে পড়বে", উত্তরে বললাম।
বয়স আনুমানিক নব্বইয়ের কোঠায়। মমতার পরশে আলোকিত মুখ, নির্ভার মন, থুরথুরে এক মেমসাহেব ঠাকুমা।
হাজার হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা আর একটি স্নেহ-দ্রবীভূত মুখের কথা সহসা মনে করিয়ে দেয়।
- "চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই"।
পরের দুঃখে এমন কাতর হওয়া মানুষে অন্যভস্ত, বিড়ম্বিত আমি বলি, "না, আরেকটু বরং অপেক্ষা করি..."।
কিন্তু ঠাকুমা নাছোড়বান্দা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ইতিমধ্যে ঝমঝম রূপে আবির্ভূতা। অগত্যা আমি ঠাকুমার ডাকে সাড়া দি। তার চোখেমুখে নির্মল আনন্দের আভা। আমি বাক্যহীন, স্নেহের শিকলে আনন্দ-পরাহত।
কত কি কানে আসে এই ঘোলা সময়ে। কত নীচ, হীন ভাবনা নিজেরই অগোচরে এ মনে ঠাঁই পায়। চামড়ার রঙ, বিশ্বাসের ভিত্তি, আর অর্থের গরিমা মানুষে-মানুষে লড়াই বাঁধাচ্ছে। "সেইসব শেয়ালেরা" প্রতিদিন ছিঁড়ে খাচ্ছে মানব-হৃদয়। পৃথিবীর আজ গভীরতম অসুখ, এখানে ওখানে ছড়িয়ে পোড়া কাঠ-কয়লার মতন অজস্স্র কারণ। অথচ বৃষ্টি-স্নাত সেই সন্ধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কালো, বাদামী, আর সাদা রঙ সব মিশে গিয়ে যে রঙ প্রস্ফুটিত হলো তা কেবল সাদা।
অমলিন অন্তরের শুভ্রতা।
ছোটবেলায় পড়েছি সাদা রঙ নাকি সব রঙের মিশ্রণ। তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে বাকি সব রঙটুকু। কালোটুকু ও।
নব্বই পেরোনো অপরিচিতা বিদেশিনী ঠাকুমা সেই শুভ্রতার অকপট প্রতীকমাত্র, এমন ক্ষয়িষ্ণু দিনেও তাই তার হাতে ধরা থাকে ভালবাসার ব্যাটন।
No comments:
Post a Comment